Header Ads

ডাক্তার-রহস্য



আজ আপনাদের সামনে ডাক্তারদের রহস্য ফাঁস করে দেবো। এই রহস্যগুলো কাজে লাগিয়ে কীভাবে আপনারা আরও ভাল সেবা পেতে পারেন, সেটা অনুসন্ধান করাই উদ্দেশ্য। সেই সাথে রোগী কিছু অধিকার সংরক্ষণ করে, সেগুলো জানলে চিকিৎসায় আপনার স্যাটিসফেকশনও বাড়বে। আশা করি, আমাদের আজকের আলোচনাটা ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক ও সেবার মান ও সন্তুষ্টি বৃদ্ধিতে একটা সিলেবাস টাইপ হবে। সব বিষয়ে হয়ত আপনারা একমত হবেন না। কারণ আমার দেখা ‘সেবাদাতা'র দৃষ্টি থেকে, আর আপনি ‘গ্রহীতা'। অবশ্য আমারও আত্মীয়স্বজন অসুস্থ হন, তখন আমিও গ্রহীতা হই। সে হিসেবে আমার বিশ্লেষণে আস্থা আপনি রাখতেই পারেন। তো শুরু করি। খুব শক্ত বাস্তবতার এঙ্গেল থেকে কথা হবে। দুর্বল হার্টের লোকেরা সাবধানে পড়বেন।

যখনই আপনি কোন প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে যাবেন, আপনাকে ধরে নিতেই হবে যে, আপনাকে নিয়ে ব্যবসা করা হবে। ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অবশ্যই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কোন লঙ্গরখানা বা দাতব্য চিকিৎসালয় না। ভাল করে মুখস্ত করে নেন, এগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আপনি তাদের খদ্দের, মুনাফার উৎস। সুতরাং আপনার থেকে মুনাফা নেয়া হবে। ‘না, তারপরও’ ‘ একটু রয়েসয়ে তো লাভ করবে' ‘সেবামূলক মনোভাব’ এগুলো প্রেমিকা টাইপ ন্যাকামো। পুঁজিবাদ নির্দয়, নির্মম। স্বাস্থ্য পুঁজিবাদের অনেক ব্যবসার মধ্যে একটা ব্যবসা, কোন ‘সেবা’ নয়। অতএব বাস্তবতা হল, আপনি যখন এখানে আসবেন, আপনার থেকে যতটুকু লাভ করা যায়, এরা করবে। প্রথম মন থেকে যে কথাটা ঝেড়ে ফেলবেন সেটা হল: ‘এরা মানবতার সেবা করার জন্য বসে আছে'। ‘সার্ভিস’ মানে যদি ‘সেবা’ হয়, তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু এই সেবা মানে যদি ঐ সেবা ধরে নেন, তাহলে আপনি স্বপ্নের জগতে আছেন। স্বাস্থ্যসেবা না বলে ‘স্বাস্থ্যব্যবসা’ বললে আপনি বা সার্ভিসদাতা কেউই প্রত্যাশার চাপে ভুগলেন না।

তো বড় বড় থেকে নিয়ে মফস্বলের অলিতে গলিতে আপনাকে সেবা না, আপনাকে ‘ব্যবসা’ করা হবে। এখানে তারা কিছু ডাক্তার বসায় অলিখিত পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। জীববিদ্যায় এই সম্পর্কটাকে আমরা বলি মিথোজীবীতা, তুমি আমাকে দিবা, আমি তোমাকে দেব। আমি তোমাকে এসি টিপটপ চেম্বার করে দেব, তোমার মার্কেটিং করে রোগী এনে দেব। আর আমার লাভ হল, তুমি টেস্ট দেবে, ক্লিনিক হলে রোগী ভর্তি দেবে, গাইনী সার্জন হলে সীজার করবে প্রয়োজন-সামান্য প্রয়োজনে। একটু বেশি বেশি দিলে ভাল হয়। আর যদি তোমার থেকে অন্য কাউকে আমি বেশি টেস্ট দিতে দেখি, তবে তোমাকে সরিয়ে তাকে চেম্বার দেব। সরাসরি না বললেও আকারে ইঙ্গিতে এই প্রত্যাশার চাপ টের পাওয়া যায়। সুতরাং টেস্ট দিলে বেজার হবেন না, বেশি দিলেও বেজার হওয়ার কিছু নাই। কারণ এরা আপনাকে নিয়ে বাণিজ্য করবে এটা আপনি জেনেই সেখানে গিয়েছেন। এই টেস্ট না দিলে আপনি এই ডাক্তার ভদ্রলোককে এখানেই পেতেন না, এখানে ডাক্তার দেখাতে পারছেন, কারণ ডাক্তারের উপর ক্লিনিক-ডায়গনোস্টিক মালিকপক্ষ সন্তুষ্ট। এখন এই যাঁতার ভিতরেই কীভাবে সর্বোচ্চ সেবাটা নিতে পারি? খরচ করতে তো সমস্যা নেই, সমস্যা হল যখন টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত সেবাটুকু পাচ্ছি না, সন্তুষ্ট হতে পারছি না। তবে বড় বড় জায়গায় অনেক কাস্টমার তো, এসব প্রত্যাশার চাপ কম। প্লাস সেবা অনেক এঙ্গেলে দেবে, নেবেও অনেক এঙ্গেলে একটু একটু। এজন্য বড় জায়গায় রোগীর সন্তোষ বেশি। চিকিৎসা নেবার আগে ‘আপনি তাদের একটা ব্যবসা’ এটা মনে করে গেলে, দেখবেন গায়ে অতটা লাগছে না।

দুই নম্বর হল, ডাক্তারের ভিজিট বেশি। আমরা ডাক্তাররা রোগীর কাছে সময় বিক্রি করি। আমি আপনাকে সময় দিব, বিনিময়ে আপনি আমাকে ভিজিট দিবেন। এখন, আমি আমার সময় কত টাকায় বেচব, এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। ‘মানবসেবা’ জাতীয় ন্যাকামো দূরে রেখে এসে কথা বলতে হবে। এটা পুঁজিবাদ-বস্তুবাদের যুগ। যান্ত্রিক ও আবেগশূন্য। এখানে টাকায় কথা বলে, কথায় কথা বলে না। আপনার যদি এই রেটে পত্তা পড়ে, আপনি আমাকে দেখাবেন, না হলে অন্য কোন ডাক্তারের ‘শপ’ এ যাবেন। চেম্বারকে আমি বলি ‘স্বাস্থ্য-দোকান’। এজন্য যেসব ডাক্তাররা চেম্বারের বাইরে ‘ভিজিট ১০০০-১২০০’ টাঙিয়ে রাখেন, তাদের আমি সাধুবাদ দিই। আমার সময়ের দাম আপনাকে জানালাম, লিলে লেন, লা লিলে লা লেন। কোনো লুকোছাপা নেই। আগে ভিতরে ঢুকিয়ে দেখে পরে দাবি করব, আর আপনি দিতে অসম্মত হবেন, বিব্রত হওয়াহওয়ি নেই। অনেকে দেখি প্রেমিকার মত গাল ফুলান, ডাক্তার কসাই, ১২০০ টাকা ভিজিট। কনজিউমারিজমের এই যুগে ১০০০ টাকা গজ কাপড়ও আছে, ৫০ টাকা গজ কাপড়ও আছে। আপনার যেটা কেনার ক্ষমতা আপনি কিনবেন। ১২০০ টাকার ডাক্তার দেখাতে না পারলে ২০০ টাকা ভিজিটের ডাক্তারও আছে। প্রফেসর তার জীবনে বহুত কাঠখড় পুড়িয়ে প্রফেসর হয়েছে, তার সময়ের দাম বেশি। তার সময় আপনাকে বেশি দামেই কিনতে হবে। কথাগুলো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, আমি জানি। বাস্তবতা আসলেই কঠিন, ভাইজান। আমাদের কল্পনার চেয়েও কঠিন।

আমরা এখন অনেক শিক্ষিত, অনেক সচেতন। বাচ্চার জ্বর-গলাব্যথা, টনসিল ফুলেছে। আমরা বুঝে নিই ‘নাক-কান-গলার’ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মাশাআল্লাহ। এখন নাক-কান-গলার প্রফেসর দেখালেন, ১০০০ টাকা ভিজিট নিল, তার অনেক রুগী, সময় কম পেলেন, এমনকি অপারেশান করানোর ব্যাপারে কনভিন্স হতে যেতেও পারেন, যেহেতু বার বার টনসিলের এটা সর্বোচ্চ চিকিৎসা পদ্ধতি, আর প্রফেসর নিজেই অপারেশান করেন, যে ক্লিনিকে দেখালেন, সেখানে তারাও ওটিচার্জ, বেডভাড়া পাবে। আবার আমাকে (সিম্পল এমবিবিএস) ডাক্তারও দেখাতে পারেন ২০০ টাকা ভিজিটে, ওষুধ দিলাম, সেরে গেল। সামান্য জ্বর-কাশি-গলাব্যথায় প্রফেসর দেখাবেন, আবার প্রফেসর প্রফেসরের মত ভিজিট নিলে পিছনে এসে গাল দিবেন, এটা কেমন কথা? সামান্য জ্বরে এত টাকা ভিজিট? এতগুলো টেস্ট? আরে ভাই, কী অসুখ সেটা তো কথা না। কথা হল, কার সময় নিচ্ছেন, তিনি কী রেটে সময় দেন, এবং কোথায় সময় নিচ্ছেন। যে বিষয়গুলো আলোচনা করছি, এগুলো হল আমাদের গ্রহীতাদের সন্তোষ কম হবার কারণ আলোচনা করছি। অতিপ্রত্যাশা এবং ভুল চয়েস সিলেকশান একটা কারণ।
কিন্তু ডাক্তাররা তো সময়ই দেয় না? হ্যা, এইটা একটা পয়েন্ট। টেস্ট বেশি দেয় এইটাও পয়েন্ট না ( সে অমৌখিকভাবে কিছুটা প্রত্যাশার চাপে, নাহলে ঐ জাগায় আপনি তাকে পেতেন না), আর ভিজিট বেশি এটাও কোন পয়েন্ট না। সময় কম দিচ্ছে এটা পয়েন্ট। তবে আমি যত প্রফেসরের কাছে গেছি, ডাক্তার হবার আগেও, সময় দেননি, বা কম দিয়েছেন, এমনটা মনে হয়নি। তবে যদি আপনি তার কাছে ৩০ মিনিট আশা করেন, তা অসংগত। আমরা যে প্যাটার্নে রুগী দেখি সাধারণত:

- ১ম ১ মিনিটকে বলা হয় ‘গোল্ডেন মিনিট'। এ সময়ে রোগী তার যত সমস্যা আছে বলবে। ডাক্তার চুম্বকাংশ নোট করবেন।
- এরপর কিছু সময় ডাক্তার তাকে সম্পূরক প্রশ্ন করে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিবেন।
- এ পর্যায়ে ডাক্তার কিছু এক্সামিনেশান করবেন রোগীর গায়ে হাত দিয়ে।
- এরপর ডাক্তার একটা আপাত রোগনির্ণয়ে চলে যাবেন।
- সেই আপাত নির্ণয়কে নিশ্চিত করার জন্য এবং অন্যান্য সম্ভাবনাকে নাকচ করার জন্য কিছু টেস্ট দেবেন।
- টেস্টের রিপোর্টের সাথে মিলিয়ে ফাইনাল সিদ্ধান্তে আসবেন এবং ওষুধ লিখবেন।
- ফাইনালি রোগের ভবিষ্যত এবং আরও কী কী ধরন আছে চিকিৎসার এসব বিষয়ে রোগীকে জানাবেন। আবার ফলোআপে কবে আসতে হবে জানাবেন। খাওয়ার বাছবিচার সম্পর্কে জানাবেন। ব্যস।
এই পুরো প্রক্রিয়া ৮-১০ মিনিটের কমে শেষ হবার প্রশ্নই আসে না।

(চলবে)

লেখকঃ
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
সহকারী সার্জন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

No comments

Ebrahim Bin Ismail . Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.