Header Ads

ডাক্তার-রহস্য -২



পর্ব-২
এই পুরো প্রক্রিয়াটা ৫-১০ মিনিটের কমে অসম্ভব। এবং আমার দেখা অধিকাংশ ডাক্তারকে আমি এগুলো মেইনটেইনই করতে দেখেছি। এতক্ষণ বেসিক আলোচনা করলাম। এবার আপনার রোগী হিসেবে কী করণীয় যদি পুঁজিবাদের যাঁতায় পিষেই (যাঁতা থেকে কোনো সেক্টরেই বাঁচতে পারছেন না, এখানেও পারবেন না) সর্বোচ্চ সেবাটা কীভাবে পেতে পারেন?
ক) আপনার যদি কারও ‘ব্যবসা’ হতে না চান, বা সামর্থ্য না থাকে, তাহলে আপনাকে সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে। খুব বড় অসুখে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা পিজিতে যেতে হবে। তবে সমস্যা হল সেখানে সবকিছুতেই বড় বড় সিরিয়াল, বেড-কেবিন থেকে নিয়ে সিটি স্ক্যান-অপারেশান-আইসিইউ সবখানেই সিরিয়াল। তবে ধৈর্য ধরতে পারলে সেখানে সব ধরনের চিকিৎসাই হবে। এবং ব্যবসার স্বীকার হতে হবে না। দালালদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বাইরে কোথাও যাবেন না। কামড়ে পড়ে থাকবেন। যে প্রফেসররা চেম্বারে ১২০০ টাকা ভিজিটে দেখেন, ওনারাই এসব স্পেশালাইজড সরকারি হাসপাতালে ভর্তিরুগী দেখেন। সুতরাং একটু লম্বা লাইন হলেও এখানে চিকিৎসা নেবেন।
খ) রোগীর অধিকার এটা যে সে তার রোগ সম্পর্কে জানবে, রোগের ভবিষ্যত পরিণতি সম্পর্কে জানবে, আর কি কি চিকিৎসা আছে সেগুলো সম্পর্কে জানবে, এবং টেস্টগুলো কী কী কারণে তাকে দেয়া হচ্ছে তা জানবে। যেহেতু আপনি টাকা খরচ করবেন, এগুলো জানার অধিকার আপনার আছে। ডাক্তার এগুলো জানাতে নীতিগত ও পেশাগত দায়িত্ব থেকে বাধ্য। যদি কোন ডাক্তার এগুলো না জানায়, সময়ের কারণে জানাতে অস্বীকার করে। আপনি তার কাছে আর যাবেন না। অন্য ডাক্তারের কাছে যাবেন, তার পেশাগত খ্যাতি যেটা আপনার দ্বারা হতে পারত, সেটা ওখানেই শেষ। এটা তার শাস্তি।
গ) কিছু অসুখ আছে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা। যেমন ডায়বেটিস, হাড়ের অসুখ, মানসিক অসুখ, হৃদরোগ। এগুলো রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের একটা দীর্ঘ প্ল্যান থাকে। নেক্সট ভিজিটে ওনাকেই দেখাবেন, আপনাকে নিয়ে কী পরিকল্পনা জেনে নেবেন। আপনি তাকে মুফতে দেখাচ্ছেন না, টাকা দিয়ে দেখাচ্ছেন। তাই নিজের রোগসংক্রান্ত সব তথ্য জেনে নেবেন, ভয় বা লজ্জা করবেন না, অধিকার বুঝে নেন । ঘন ঘন ডাক্তার সুইচ করবেন না, তাহলে প্রতি ডাক্তারই আপনার চিকিৎসা শুরু থেকে শুরু করবে। ডাক্তার যদি পছন্দ হয়, এরপর পীরসাহেবের মত তাঁর সাথেই লেগে থাকবেন।
ঘ) স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফুল সেটআপে আপনার সামনে বসা ডাক্তারটাকেই একমাত্র আপনার পক্ষে আনতে পারবেন। এছাড়া এই পুঁজিবাদী সিন্ডিকেটের কেউ আপনার পক্ষে নেই। প্রতিটা ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়তে যায় ‘মানবসেবা’র স্বপ্ন নিয়েই। পুঁজিবাদ-বস্তুবাদ মিলে তাকে রূঢ় করে তোলে। আমার বেশক’টা রুগী আছে সেক্সুয়াল সমস্যার। ভায়াগ্রা ডেরিভেটিভ ব্যবহার না করে আমি মাস দুয়েক তাদের চিকিৎসা করি, এরপর কাজ না হলে রেফার করি। অনেকেই সাফল্যের সাথে স্ত্রীসহবাস করছেন। একজনের ১০ মাসের সংসার ভেঙে যাচ্ছে বলে আমি তার শ্বশুরকে পর্যন্ত ফোন করেছি, আমাকে ৩ মাস সময় দেন। এরপর দরকার হলে আপনাদের মেয়ে নিয়ে যায়েন। যদি দেখি আমার চেম্বারে ডায়গনোস্টিকের কোন প্রেসার আছে হয় আমি আর চেম্বার করিনা, না হয় কোন টেস্ট যদি আমাকে দিতে হয় যা আমার করার কথা না, আমি ভিজিট ফেরত দিয়ে দিই। মোট কথা, ডাক্তারই একটা লোক যাকে আপনি আপনার পক্ষে আনতে পারলে পুঁজিবাদের এই ‘ব্যবসা’ হওয়া থেকে একটু লাঘব পাবেন। তাকে পক্ষে আনতে পারলে এমন অনেক কিছুও সে আপনার জন্য করবে যা তার করার কথা না। সুতরাং গোল্ডেন মিনিটে তাকে পক্ষে আনুন। জাস্ট দুটো বাক্য। “স্যার, অনেক জায়গায় চিকিৎসা হয়েছি, টাকাপয়সা খরচ করেছি। শেষমেশ আপনার নামডাক শুনে আপনার কাছে এলাম”। ডাক্তারের কাছে আপনি আকাশসমান আশা নিয়ে এসেছেন তার সুনাম শুনে, এটা তাকে বুঝাতে পারলেই ‘কেল্লা ফতে'। সেই সুনাম ধরে রাখার জন্য হলেও সে আপনাকে এক্সট্রা কেয়ার নিয়ে দেখবে।
ঙ) যার জ্ঞান বেশি সে ভাল ডাক্তার হবে এমন কোন কথা নেই। পেশেন্ট ডিল করা ভিন্ন একটা যোগ্যতা। ভালো ডাক্তার চিনবেন কীভাবে:
- ডিগ্রী থাকবে। খুব বেশি জটিল রোগ না হলে খুব বেশি ডিগ্রীঅলা ডাক্তারের কাছে যাবার দরকার নেই। বেশি ডিগ্রী মানে ‘বিরল’ রোগ ধরার যোগ্যতা আছে তার। এখন বিরল রোগও বিরল। অধিকাংশ অসুখ যা আমাদের হয় সচরাচর সেগুলো ধরতে ও চিকিৎসা করতে খুব প্রচুর উচ্চতর ডিগ্রী লাগে না। বর্তমানে বাংলাদেশের এফসিপিএস ও এমডি ডিগ্রীই প্রায় আমাদের ৯৫% রোগ সঠিকভাবে ধরা ও চিকিৎসা করার জ্ঞান দেয়। সুতরাং শুরুতেই নিজেকে বিরল রোগে আক্রান্ত মনে করবেন না, যে রোগ একজন এফসিপিএস ডাক্তার ধরতে পারবেন না, আরও ডিগ্রীওলা লাগবে।
- রোগ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য রোগীকে সরবরাহ করার মানসিকতা রাখেন। কোন টেস্ট কেন দিচ্ছি, লেখার ফাঁকে ফাঁকে একটু বলে দিলে কী ক্ষতি।
- রোগীকে কথা বলতে দেন, রোগীর কথা শোনেন।
- দিনে নির্দিষ্ট পরিমাণ সিরিয়াল নেন। দিনে এতগুলোর বেশি রুগী দেখবো না, এমন মানসিকতা রাখেন। যত বেশি রুগী, রুগীপ্রতি সময় তত কম। এজন্য যে ডাক্তারের রোগী খুব বেশি, সেখানে যাবেন না, তিনি আপনাকে চাইলেও বেশি সময় দিতে পারবেন না, দিন তো ২৪ ঘন্টাই। একই মেধার ডাক্তার আরও আছে।
চ) প্রথমে ছোট ডাক্তার দেখাবেন। কারণ আমাদের ৯০% অসুখই ছোটখাট অসুখ। এরপর যদি লাগে, সে আরও বড় ডাক্তারের কাছে পাঠাবে, হতে পারে তারই কোন স্যারের কাছে পাঠাবে। ছাত্র পাঠিয়েছে দেখলে সেই স্যারও আন্তরিক বেশি হবেন। একজন এমবিবিএস ডাক্তারের সেই যোগ্যতা আছে যে সে ৯৫% রোগ ধরতে পারে এবং ৮০% রোগের পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারে। সুতরাং এমবিবিএসকে ছোট করে দেখার যে কালচার তৈরি হয়েছে তার পিছনে অবশ্য মানহীন মেডিকেল কলেজ অনুমোদন অনেকটাই দায়ী।
ছ) ডাক্তারকে নিজ থেকে কোনো সাজেশান দেবেন না। আমি যে স্যারকে ব্যবহারের দিক থেকে মেন্টর ভাবি (জ্ঞানের দিক থেকে হতে পারব না)। প্রফেসররা দিনের বেলা ক্লাস নেয়া, নানান সরকারি সেমিনার, প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। কোনোদিন রাউন্ড দিতে না পারলে রাতে চেম্বার থেকে বাসায় ফেরার সময় ক্রিটিক্যাল রুগীগুলো দেখে যেতেন। যদিও তখন সরকারি টাইম না, দিনেও তিনি সরকারি কাজেই ছিলেন। তো স্যারকে দেখতাম, কেউ যদি বলেছে, স্যার, ইন্ডিয়াতে নিয়ে গেলে মনে হয় ভাল হবে। আপনি কী বলেন? স্যার বলতেন: হ্যা হ্যা তাই তো। ইন্ডিয়াতে নিয়ে যান। অথচ অসুখটা এমন জটিল কিছু না। স্যার বলতেন: রোগী যদি তোমার উপর আস্থা না পায়, তুমি তাকে দেখবা না। সে কখনোই তোমার হাতে সুস্থ হবে না। এজন্য নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কোন সাজেশন দেবেন না। গ্যাসটিক আল্ট্রাসনোতে বুঝা যায় না। আমি বুঝতেসি রুগীর গ্যাসটিক। রুগী বলল, স্যার, একটা আল্ট্রা করে দেখলো হত না? আমি জানি, ওর আল্ট্রা করার দরকার নেই। এরপরও দিতে হবে। আল্ট্রা না করায়ে যত ওষুধই দিই, সে ভাল হবে না।
(চলবে)

লেখকঃ
এমবিবিএস,বিসিএস (স্বাস্থ্য)
সহকারী সার্জন,স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।


No comments

Ebrahim Bin Ismail . Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.